avertisements
Text

'যৌনস্বাস্থ্য নিয়ে হীনমন্যতা নয় দরকার স্বস্তিকর আলোচনা'

| প্রকাশ: ৭ জুলাই, মঙ্গলবার, ২০২০ | আপডেট: ৩ মে, শুক্রবার, ২০২৪

পিরিয়ড, রিপ্রোডাকটিভ চেইন্জ, অর্গান, স্বপ্নদোষ, মাস্টারবেশন, কনডম ও স্যানিটারি প্যাডের সাথে কিছু বিচ্ছিন্ন অভিজ্ঞতা সরল স্মৃতিচারণে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
মাগুরা সরকারি গার্লস স্কুল। ক্লাস সিক্সে পড়ি। আম্মু তখন প্রেগন্যান্ট। লীজান আম্মুর ভেতরে। আব্বুর অফিস মাগুরা সদরে। অাম্মুর স্কুল আরো ভেতরে,গ্রামের দিকে।অামি সদরে নানীবাড়িতে থাকি,ছুটির দিনে বাড়িতে যাই অাব্বুর সাথে। আব্বু-আম্মু আমাকে ক্লাস সিক্সে সদরের স্কুলে ভর্তি করে কারন সদরে তাদের সেটেল্ড হওয়ার প্লান ছিলো।
একদিন ইসলাম শিক্ষা ক্লাস করতে "ক" শাখায় গিয়ে দেখি সেই এক শোরগোল। ক্লাসের অনামিকা নামের এক মেয়ের পিরিয়ড হইছে।সাদা সালোয়ারে পিরিয়ডের লাল দাগ লেগেছে।সে স্কুলের সম্মুখ মাঠের ট্যাপকলে ওই দাগ ধোয়ার চেষ্টা করছে অার কাঁদছে।বাকিরা তাকে দূরে দাড়িয়ে দেখছে।কেউ কেউ মুখটিপে হাসছে,কেউ আমার মত কিংকর্তব্যবিমূঢ়।একটুপর প্রধান শিক্ষিকা অাসলেন।ক্রন্দনরত অনামিকাকে নিয়ে যাওয়া হলো।পরে শুনেছি অভিভাবক ডেকে তাকে বাড়িতে পাঠানো হয়েছিলো।এরপরে অনেকদিন অনামিকা স্কুলে অাসেনি লজ্জায়।ক্লাসে তিন অনামিকা ছিলো।ওকে সহজে চিনতে ওর নাম হয়ে গেল "পিরিয়ড হওয়া অনামিকা"!
ক্লাস সেভেনের মাঝামাঝিতে প্রথম সাময়িকের শেষ পরীক্ষা দিচ্ছি। বাইরে আসতেই এক বান্ধবী অামাকে হিঁচকে টেনে ফিসফিসিয়ে বললো।"এই তোর পিরিয়ড হয়ে গেছে।"পেছনে ফিরে দেখলাম জামায় পিরিয়ডের দাগ।পরিবারের কেউ কখনো আলোচনা করেনি অামার সাথে এইবিষয়ে।মাকে বরাবরই ভয় পেতাম। তবে ক্লাস সেভেনের গারস্থ্য অর্থনীতি বই পড়ে এবং ক্লাসমেটদের মাধ্যমে অামি টুকটাক জেনেছিলাম পিরিয়ড নিয়ে। আতঙ্কে কেন জানি কেঁদে ফেললাম। কোনরকম একা এক রিকশা ঠিক করে বাসায় চলে আসলাম।
আমার নানা-নানী বৃদ্ধ। আমি তাদের কারোর সাথেই ওতটা ফ্রী না।তো রুমে ঢুকেই দরজাবন্ধ করে ফুঁপিয়ে কান্না শুরু করলাম।কোন কারন নেই।শুধুই শুধুই কাঁদছি।গা কাঁপছে আমার। কি করবো ওই অবস্থায় জানিনা।
রুকসানা আপা নামের এক আপা টুকটাক ঘরের কাজ করতো নানীবাড়ির।সংকোচ ফেলে আপাকে বললাম। অনুরোধ করলাম কাউকে যেন না বলে। আপা নানীকে বলে দিলো। নানী তার পুরনো শাড়ি যেগুলা কাঁথা সেলাইয়ের জন্য রাখছিলো সেখান থেকে আমাকে কিছু টুকরো কাপড় দিলো। রুকসানা আপা দেখিয়ে দিলো কিভাবে বাঁধতে হয়।পরতে হয়।
আমার হুটহাট কান্না পেত তখন। আমাকে বলা হলো এখন মন খারাপ হলেও হাসিখুশি থাকতে হবে তানা হলে সবাই জেনে যাবে।অামি খুবই সাবধানে থাকতাম,পেটে ব্যথা,বমি লাগতো তবুও হাসতাম। নানী খেতে দিয়ে বলতো,"এসময় ডিম খাইস বেশি।মাছ খাইস না।"জানলাম এইসময়ে মাছ এড়িয়ে চলা ভালো। পা টিপে টিপে চলাচলও করতাম সাবধানে যাতে টুকরো কাপড় অসাবধানতায় পড়ে না যায় । এখন মনে হয় পিরিয়ড লুকানো এই কষ্ট তখন কেন করেছিলাম? সবাই জানলে কি হতো অাসলে?
পরীক্ষা শেষে আব্বু নিয়ে গেল বাড়িতে।আম্মু হয়তো জেনে গিয়েছে নানীর থেকে,তবে আমাকে কিছু বলেনি। পরের মাসে যথারীতি আমার পিরিয়ড হলোনা।আম্মুকে তখন প্রেগনেন্সিকালীন চেকআপ করতেন মাগুরার গাইনি বিশেষজ্ঞ সখেনা খানম বেলি। আম্মুর সাথে ওইখানে গেলাম একদিন। তো আম্মুকে ইশারা করলাম ওনাকে আমার সমস্যার কথা বলতে। উনি হেসে বললেন প্রথম প্রথম পিরিয়ড হলে এরকম ইররেগুলারিটি স্বাভাবিক।দুশ্চিন্তার কিছু নাই।
আমার দুশ্চিন্তা গেলো না। ইন্ট্রোভাট ছিলাম ভীষণ।বান্ধবীরা তখন আমাকে নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা করতো। ফাজিল এক বড় আপু বললো,"পিরিয়ড হচ্ছে না কেন হু? সেক্স টেক্স করিসনিতো ?" যাতা বলবেনা বলে,সেই আপুর সাথে কথা বলাই বন্ধ করে দিলাম।
অতঃপর আমার কাঙ্ক্ষিত পিরিয়ড আপনা-আপনিই হলো পরের মাসে।লীজানের ক্ষেত্রে আম্মুর ভ্যাজাইনাল ডেলিভারি হয়। ওর জন্মের পর আম্মুরও অনেকদিন পিরিয়ড ছিলো।তখন খুঁটিনাটি আরো বেশি জেনেছি।
পিরিয়ড হয়ে যাওয়ার পরে আমার পৃথিবীটা কেমন জানি ছোট হয়ে এলো।এত এত নিষেধ।সাইকেল চালাবা না,লাফালাফি-ঝাপাঝাপি করবা না,সাবধান করতো আম্মু।এইসব নিষেধের যুক্তি বড় হয়ে খুঁজেছি।নারীশরীরে হাইমেন নামের টিস্যু থাকে যার নামকরণ হয়েছে"সতিপর্দা" নামে।এই পর্দা লাফালাফি ঝাঁপাঝাপিতে ছিড়ে গেলেও মেয়েলোক অসতী হয় বলে ধারনা করা হয়।এই পর্দা না থাকলে নারী জীবন নাকি অসম্মানের। এই পর্দা নাকি ভার্জিনিটির স্মারক।যেকোনো মূল্যে ওই হাইমেন টিস্যুকে অক্ষত রেখে বিবাহ করাই হলো নারীর সতীত্বের অগ্নিপরীক্ষা ! এইটাই ভার্জিনিটি ! হলি কাউ!!
এইসব কিউট অজ্ঞতার আরেকটা গল্প মনে পড়েছে। তখন ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ার। লীজান বেশ বড় হয়ে উঠেছে। অামার খালা প্রতি ঈদেই প্রায় আমাকে অনেকধরনের কসমেটিকস এর সাথে স্যানিটারি প্যাড পাঠাতো।যেহেতু খালু ডাক্তার এইগুলা ফ্রীতেই পেতো তারা। তো এইরকম একবার পাঠিয়েছে। আমি দুদিন পর আমার পারফিউম ও স্যানিটারি প্যাড কোথাও খুঁজে পাই না। পরে দেখি ওটা টেবিলের ড্রয়ারে। লীজান চুরি করে রেখেছে।পারফিউমকে সে ঠিকঠাক চিনলেও,বেল্টসিস্টেম স্যানিটারি প্যাডকে সে ভেবে নিয়েছে বিদেশি টিস্যু! সে প্যাকেট খুলে ঘাম মুছে একটা খোলা প্যাড ড্রয়ারে রেখেও দিয়েছে।
পরবর্তীতে ওকে বুঝিয়েছি,রিপ্রোডাকটিভ হেলথ,চেইন্জ,অর্গানগুলো সম্পর্কে।এ্যাডোলোসেন্ট পিরিয়ডের সার্বিক পরিবর্তন নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করেছি। আমি চেয়েছি ওর ভেতরের এইসব চেইঞ্জ গুলো নিয়ে ওর পরিষ্কার ধারনা থাকুক। আমার মত এক ভ্রান্তসমুদ্রে ও না পড়ুক।
তথাকথিত ট্যাবুর বাইরে গিয়ে, বিপরীত সেক্সের চেইন্জের প্রতিও লীজান সংবেদনশীল হোক।সহমর্মী হোক।ওকে স্পেস দিয়েছি ওর কৌতূহল অামাকে জানানোর। ঢাকা বসে ওর বডিস্প্রে,ইলেকট্রিক রেজার,আন্ডারওয়্যার কিনে আমি কুরিয়ার করি।বাড়িতে গেলে প্যাড না থাকলে ও ফার্মেসি থেকে প্যাড কিনে অানে।এইটা হলো আমার ১৩ বছরের ছোট ভাইটার সাথে আমার বোঝাপড়া।
এখন অাসি তর্কে। তর্কটা আপনাদের সাথে যারা পিরিয়ডের সাথে স্বপ্নদোষ /মাস্টারবেসনকে গুলিয়ে ফেলে চিল্লাচিল্লি করছেন। ঠিক যেভাবে গুলিয়েছেন একটা স্যানিটারি প্যাডের সাথে একটা কনডমের পার্থক্য।
পিরিয়ড প্রতিমুহুর্তে শরীর থেকে ব্লেড দিয়ে চিরে নেওয়ার মত রক্তক্ষরণ।অসহনীয় ব্যথা,জ্বর-বমি বিরক্তি, নির্ঘুম রাত। যাকে হার্টঅ্যাটাকের সাথেও তুলোনা করেন চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা।এই কঠিন অনুভূতির সাথে কিছুতেই সাময়িক যৌনসুখ অর্থাৎ স্বপ্নদোষ /মাস্টারবেসনের তুলনা চলেনা। কখনোই না। পিরিয়ড নিয়ে চিল্লাইতে বলছিনা।খোলামেলা অালোচনা করতে বলছি ৷বিবেচকশ্রেনী পর্যন্ত একটা এ্যাডভারটাইজমেন্ট ইস্যুকে কেন্দ্র করে কি যে নোংরামো করলো সেইটা অার বলবার ভাষা নাই। একটা শিশুকে ছোটবেলা থেকেই নোংরা রক্ত,লজ্জার জিনিস,রাখঢাক করা উচিত,এটা করিস না,ওটা ঠিকনা বলে একধরনের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বে ফেলে দেওয়া হয়।পিরিয়ড নিয়ে আলোচনাকে অনুৎসাহি করা হয়।অাতঙ্কগ্রস্ত করা হয়।তাই এখন আলোচনা, প্রচার,প্রকাশ হলেও সেটাকে চিল্লানো মনে হচ্ছে সবার! আফসোস!
আমি এমন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি যেখানে নারী-পুরুষ পরষ্পরের রিপ্রোডাকটিভ চেইন্জগুলো নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করবে।স্যানিটারি প্যাড লুকিয়ে বিক্রি হবেনা।প্যারাসিটামল,সিভিট,স্যালাইনের মত প্রকাশ্যে বিক্রি হবে।মেয়েদের রিপ্রোডাকটিভ অর্গানে ব্যবহৃত পোশাকগুলো শুকোতে দেখলে কারোর মধ্যে যৌনানুভূতি জাগবে না।কোন বোন স্যানিটারি প্যাড,ইনারগুলো ড্রয়ারে লুকিয়ে ব্যবহার করবেনা। প্রতিটা মেয়ে তার বাবা, ভাই,অর্ধাঙ্গের হাতধরে বলার আত্মবিশ্বাস রাখবে যে তার কষ্ট হচ্ছে,পিরিয়ডের ব্যথাটা তীব্র! প্রতিটা পুরুষ নারীর প্রতি এ্যাম্পেথেটিক হবে,নিজেরা প্যাড কিনে দিবে।পিরিয়ড ইস্যুটাকে নোংরা বা লাফটার ইস্যু হিসেবে না নিয়ে সংবেদনশীল অাচরণ করবে। সকল ট্যাবু ভেঙে সংকট ফেলে সবকিছু স্বাভাবিকীকরনের অন্যরকম এক বাংলাদেশের স্বপ্ন আমি দেখি।
লেখক : ফারজানা হাবিব লাবণ্য, অভিনেত্রী ও নারী উন্নয়নকর্মী
<!--/data/user/0/com.samsung.android.app.notes/files/clipdata/clipdata_200707_140954_601.sdoc-->

avertisements